স্বাস্থ্যখাত নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের আবার তোপের মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তাঁর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা। স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন অনিয়ম, অক্সিজেন সংকট, বিভিন্ন হাসপাতালে মানুষের মৃত্যু, করোনা চিকিৎসায় চরম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে এই দাবি জানানো হয়েছে সংসদে।
আজ শনিবার সংসদের পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ‘নির্লজ্জ’ বলেও আখ্যায়িত করেন। এ সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে ছিলেন। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অধিবেশনকক্ষে দেখা যায়নি।
কোভিড চিকিৎসার সময় নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন উল্লেখ করে সংসদে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে একটি কিস (চুমু) করার কারণে তাঁকে রিজাইন (পদত্যাগ) দিতে হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী মানুষ, বুঝলাম না। উনার লজ্জা-শরম কিছু নাই, চরিত্র নাই। উনার রিজাইন দেওয়া উচিত।’
সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করেন। আজকে খবর আসছে, বাংলাদেশের ৩৭টি জেলায় অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে পাঁচজন রোগী অক্সিজেন পায় তো ২০ জন লাইনে থাকে। কেবল অক্সিজেনের কারণে যারা ছটফট করে মারা যাচ্ছেন।’
বিএনপির সংসদ সদস্য গোলাম মুহম্মদ সিরাজ বলেন, বগুড়া এখন করোনার হটস্পট। গত তিনদিনে সেখানে ২৪ জন মারা গেছেন। সেখানে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সংকট। সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। জেলার তিনটি কোভিড হাসপাতালে করোনা রোগীতে ঠাসা।’
এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেন বিএনপির আরেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদও। তিনি বলেন, ‘গত বুধবার সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের মাধ্যমে গোটা হাউসকে অপমান করা হয়েছে। মন্ত্রী বলেছিলেন, যে সাংসদেরা জেলা হাসপাতালের চেয়ারম্যান হলেও দায়িত্ব পালন করেন না। মন্ত্রীর এই বক্তব্য ঠিক নয়। এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা দরকার।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘সেদিন সংসদে আমি সার্জিক্যাল মাস্ক কেনা নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমরা আশা করেছিলাম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেটা তদন্ত করবেন। বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বললেন, এটি সত্য নয়। এজন্য আজকে আমি তথ্য-প্রমাণ নিয়ে এসেছি। সংসদীয় কমিটি বিষয়টি আলোচনা করেছে, দুদকে গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। সত্য বিষয়টি এড়িয়ে না গিয়ে উনার তদন্ত করা উচিত ছিল।’
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘জিজ্ঞেস করলেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সব দিচ্ছি। কিন্তু কোথাও কিছু নেই। একটি হাসপাতালেও অক্সিজেন নেই। এভাবে আমরা একটা বছর সময় নষ্ট করেছি। আমাদের সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব দিলে, অর্থ দিলে আমরা সবকিছু ঠিক করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের ওপর দায়িত্ব নয়। দায়িত্বে যারা আছেন, তারা তো দুদিন পরে চলে যান। জবাবদিহিতা তো তাদের নেই।’
কাজী ফিরোজ রশীদ আরও বলেন, ‘বেদনাদায়ক বিষয়, সাতক্ষীরায় হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে সাতজন কোভিড রোগী এক ঘণ্টার মধ্যে ছটফট করতে করতে মারা গেছে। এই সাতক্ষীরা হলো এর আগে যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন রুহুল হক সাহেবের এলাকা। এইখানে তো ফাইভস্টার হাসপাতাল হওয়া উচিত। অক্সিজেনের অভাবে কিভাবে রোগী মারা যান বুঝি না। মন্ত্রীরা যান আসেন, নিজের এলাকাডাও ঠিক রাখতে পারেন না?’
‘অক্সিজেন প্ল্যান্ট করা অত্যন্ত সেনসিটিভ কাজ। সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা প্রপার ডিজাইন করে অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসাতে হয়। অক্সিজেন সাপ্লাই লাইনে প্রোপার ডাইমেনশন থাকতে হবে। এখানে যদি কোনো লিকেজ থাকে, তাহলে আগুন ধরে যাবে। মন্ত্রী সাহেব ভালো করে জানেন। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেল। ঠিক আছে, আপনি ম্যানুয়াল করতেন। সিলিন্ডার মুখে দিলে জীবনটা তো বাঁচত কিছুক্ষণের জন্য। পারলেন না। নার্স, ওয়ার্ড বয়, ডাক্তার কী কাজ করলো দেখবেন না আপনি? আমরা তো রোগী আইসিইউতে ঢুকায়ে দেই। যাওয়ার পর কী চিকিৎসা হয় কেউ খবর রাখে না। ওইখানে অধিকাংশ রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। বলে যে রোগীর অবস্থা খারাপ। ভেন্টিলেশন দিচ্ছি। এক ঘণ্টার পর বলে রোগী মারা গেছে, নিয়ে যান। কোনো চিকিৎসা হয় না।’
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘একটা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত আমাদের সামনে আসল না। সারা পৃথিবীতে মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু এইভাবে চিকিৎসা দিতে গিয়ে এই ধরনের অনিয়ম মানা যায়? অনেক কিছু নাকি দিল। একটা হাসপাতালে অক্সিজেন নেই। হাই ফ্লো ক্যানুলা নেই। বগুড়া হাসপাতালে অক্সিজেনই নেই। জিজ্ঞেস করলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলে সব দিচ্ছি, কোথাও কিছু দেয়নি। এইভাবে একটা বছর সময় নষ্ট করেছি। এক বছরের মধ্যে হাসপাতাল ওয়েল ইকুইপড করতে পারতাম। আমাদের এমপিদের দায়িত্ব দিত, সব কিছু করে দিতে পারতাম। কিন্তু দায়িত্ব না দিয়ে আমলাদের দেয়। জবাবদিহি আমাদের করতে হয়।’
আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য জি এম সিরাজ বলেন, বগুড়া কোভিডের হটস্পট। গত তিন দিনে বগুড়ায় মৃতের সংখ্যা ২৪ জন। মৃত্যুর কারণ হলো উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংকট। আজকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। থাকলে ভালো হতো।’ তিনি বগুড়ায় ২০টি করে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সরবরাহ এবং সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহের দাবি জানান।
জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, মাস্ক নিয়ে কথা হলো। সেদিন আমি এখানে বলেছিলাম, মন্ত্রীকে ডিরেক্ট বলিনি। বলেছিলাম, চার টাকার মাস্ক ৩৫৬ টাকায় কেন কেনা হলো? উনি তদন্ত করবেন, দেখবেন, ব্যবস্থা নেবেন। এই হলো মন্ত্রীর দায়িত্ব। তিনি সেটা এড়িয়ে বললেন, এটা সত্য না। আমি তথ্য-প্রমাণ নিয়ে এসেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। দুদকে চলে গেছে। পত্রিকায় এসেছে। ওনাদের একটি প্রকল্পের পিডি স্বীকার করেছেন। উনি বলেছেন, উনি ওই সময় ছিলেন না। উনি কী করবেন? স্বাস্থ্যমন্ত্রী এড়িয়ে না গিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতেন। ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নিতে হবে।’
Leave a Reply